প্রেমপত্র। সে যদি হয় রাজকন্যার, ১২০ বছর আগে লেখা। কোনো সন্দেহ নেই, আজ তার একটি বাক্য পড়ে পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে ভাবতে হবে। দিঘাপতিয়ার রাজকন্যা ইন্দুপ্রভার গোপনে তুলে রাখা এ রকম ২৮৫টি পত্রের সন্ধান মিলেছে। নাটোর জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে চাবিহীন একটি ট্রাঙ্ক থেকে গত সোমবার (৫ মার্চ) এগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। শুধু পত্র নয়, পাওয়া গেছে তাঁর অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি, দিনলিপি, রুপার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, প্রাচীন পদ্ধতিতে লেখার কাজে ব্যবহৃত রাজকন্যার দোয়াত-কলমসহ আরও অনেক কিছু।
এ ছাড়া গ্রামের মানুষের বাড়িতে মিলেছে রাজবাড়ির সিন্দুক, রাজা-রানির ছবিসহ অনেক ঐতিহাসিক জিনিসপত্র। এর সঙ্গে এত দিন আড়ালে থাকা মহামূল্যবান পাথরখচিত রাজমুকুট, রাজপরিধেয়—সবই আজ (৯ মার্চ) উত্তরা গণভবন সংগ্রহশালায় দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
১৯৫৬ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে এই রাজপরিবার ভারতে চলে যায়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু রাজবাড়িটিকে উত্তরা গণভবন ঘোষণা করেন। তখন থেকে এর পরিচর্যা করত গণপূর্ত বিভাগ। কয়েকবার এখানে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে।
সম্প্রতি এই রাজবাড়ি থেকে গোপনে আমগাছ কেটে নেওয়ার পর তোলপাড় হয়। এরপর গত অক্টোবর মাসে জেলা প্রশাসন রাজবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। এরপর জেলা প্রশাসন খোঁজা শুরু করে দিঘাপতিয়ার রাজার স্মৃতিচিহ্ন, কোথায় কী আছে। এলাকায় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে সিন্দুক, রাজা-রানির ছবিসহ অনেক কিছু। জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে একটি ট্রাঙ্কের ওপরে লেখা রয়েছে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা। ট্রেজারিতেই পাওয়া যায় মহামূল্যবান পাথরখচিত রাজার মুকুট, জরির জামা, হাতির দাঁতের হাতল লাগানো ছুরি, দামি পাথর কেটে তৈরি রাজবাড়ির থালাবাসনসহ অনেক কিছু।
এরই মধ্যে একটি ছবিও পাওয়া যায়। এটি রুপার ফ্রেমে বাঁধানো। ছবিটির পরিচয় খুঁজতে গিয়ে ফ্রেম খোলা হয়। এর পর দেখা যায়, ফ্রেমে আড়াল হয়েছিল রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার নাম। রাজবংশের চতুর্থ পুরুষ প্রমথনাথের কন্যা ছিলেন ইন্দুপ্রভা। গত সোমবার ট্রাঙ্ক থেকে বের করা হয় ইন্দুর হাতের লেখা ১০টি ডায়েরি। এর মধ্যে একটিতে শুধু কবিতা। অন্যগুলোতে তাঁর আত্মজীবনী। ইন্দুর কাছে বিয়ের আগে ও পরে ২৮৫টি চিঠি লিখেছেন মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী।
প্রতিটি চিঠির শেষে লেখা রয়েছে, ‘তোমারই মহেন্দ্র’। ইন্দুকে সম্বোধন করা হয়েছে ‘প্রিয়তমে’ হিসেবে। চিঠির পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে মান-অভিমান। ইন্দুপ্রভা কলকাতায় থাকার সময় তাঁকে তিনটি ঠিকানায় চিঠি দিয়েছেন। আবার ইন্দু যখন রাজবাড়িতে থেকেছেন, তখনো কলকাতা থেকে মহেন্দ্র তাঁকে চিঠি লিখেছেন। দিঘাপতিয়া চিঠিপত্রে তাঁর নাম কখনো রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা, কখনো শ্রীমতী ইন্দুপ্রভা দেবী আবার কখনো শ্রীমতী ইন্দুপ্রভা চৌধুরানী লেখা পাওয়া গেছে। মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ইন্দুপ্রভার স্বামী। তবে তাঁর বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি।
ছোট্ট ছোট্ট খামে ভরা চিঠিগুলো খুবই যত্নে ভাঁজ করে রাখা। প্রায় ১২০ বছর বা তার কাছাকাছি সময় ধরে চিঠিগুলো ওভাবেই খামের ভেতরে রয়েছে। চিঠিগুলো এখনো পড়া যাচ্ছে। একইভাবে ইন্দুর হাতের লেখা কবিতা ও তাঁর আত্মজীবনীও পড়া যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগর কবিতায় ইন্দুপ্রভা লিখেছেন, ‘সচঞ্চল নীল জল করিছে কি ঝলমল/জ্যোৎস্না মাখিয়া গায় সমুজ্জ্বল নিরমল’। ডায়েরির অনেক লেখাই তিনি রাজশাহীতে বসে লিখেছেন। ১৩১১ বঙ্গাব্দের নববর্ষের দিনের কথা লিখেছেন রাজশাহীতে বসে। রাজশাহীকে তখন রামপুর লেখা হতো। প্রতিটি লেখার সঙ্গে তিনি বাংলা ও ইংরেজি তারিখ বারসহ লিখেছেন।
১৩০৪ সালে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির প্রাইভেট সেক্রেটারির প্যাডে মহেন্দ্র কলকাতার ঠিকানায় ইন্দুকে লিখেছেন। বারবার তাগাদা দিয়ে খাম পাঠিয়েও ইন্দুর চিঠি পেতে দেরি হওয়ায় মহেন্দ্র তাঁর চিঠির শেষ বাক্যে লিখেছেন, ‘একবার কলকাতায় যেতে পারলে বাঁচি’।
তখন যে দোয়াত-কলম ব্যবহৃত হতো সেগুলোও অবিকল রয়েছে ইন্দুর ট্রাঙ্কে।